বরিশালের ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত

বরিশালের ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত

ভাষা মানুষের আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা, চেতনা অভিব্যক্তি সবকিছু প্রকাশের প্রধান বাহন। যেকোনো ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ স্বাদ পাওয়া যায় নিজের মাতৃভাষা/ প্রাণের ভাষায় কথা বলে। বরিশাল অঞ্চলের মানুষও তাদের প্রাথমিক মাতৃভাষা – বরিশাইল্যা ভাষায় ভাব প্রকাশ করে। এই অঞ্চলের মানুষজন শুদ্ধ বাংলা ভাষাতেও কথা বলে। তবে তাদের মূল পরিচয় আঞ্চলিক ভাষাতেই। মূলত বরিশাইল্যা ভাষাটি বাংলা ভাষার বঙ্গালি উপভাষার একটি অংশ। বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলার মানুষ বরিশালের ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে ব্যাপক আগ্রহী।

জনমানুষের কাছে বরিশালী উপভাষার বৈচিত্র তুলে ধরতে- বরিশালী ভাষা, ভাষার বৈশিষ্ট্য, বরিশাইল্যা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ, আঞ্চলিক বিস্তার, বরিশালের উপভাষার শব্দ, বাক্য, প্রবাদ-প্রবচন, লোকসাহিত্য, লোকসংগীত, ভাষা শেখার উপায় ইত্যাদি বরিশালের ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো এই নিবন্ধে।

সূচিপত্র

বরিশালের ভাষা

বাংলাদেশের বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। তবে বাংলা ভাষার অভ্যন্তরেই তাদের নিজস্ব উপভাষা উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি ও শব্দ ভান্ডার রয়েছে। 

বরিশাল জেলার পূর্ব দিকে রয়েছে মেঘনা নদী ও লক্ষীপুর জেলা; পশ্চিমে গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলা; উত্তরে চাঁদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা; এবং দক্ষিনে রয়েছে বরগুনা, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালী জেলা। এ সকল জেলার মধ্যবর্তী স্থানে থাকায় আশেপাশের অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা গুলো বরিশাল অঞ্চলের ভাষাকে প্রভাবিত করে। অতীতে বরিশালকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে নানান বাণিজ্য হতো। তার ফলশ্রুতিতে বিদেশি বণিকদের ভাষার সংস্কৃতি বাংলায় প্রভাব বিস্তার করে বরিশালের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষার উদ্ভব হয়েছিল।

বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের চারপাশ এবং মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বহু নদী। যেমন: মেঘনা, কালীজিরা, সন্ধ্যা, তেঁতুলিয়া, আড়িয়াল খাল, ইলিশা, কীর্তনখোলা ও বাকেরগঞ্জ মোহনা। পূর্বে নদীমাতৃক এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান কাজ ছিল কৃষি। ফলে ভৌগলিক, সংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও বৈদেশিকতার প্রভাবে বরিশালী ভাষার উচ্চারণে এক প্রকার টান দেখা যায়। যা বরিশালের ভাষাকে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ থেকে ভিন্ন করেছে।

শুদ্ধ বাংলা ভাষা ও বরিশাইল্যা আঞ্চলিক ভাষা ছাড়াও বরিশালে আরো বহু ভাষার প্রচলন রয়েছে। বিশেষ করে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। এছাড়া রয়েছে আশেপাশের জেলাগুলোর অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা। তাই ভাষার বৈচিত্র্যে বরিশাল অঞ্চল অনেকটাই পরিপূর্ণ।

বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য

বাংলা ভাষার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা একে প্রমিত বাংলা থেকে ভিন্ন করে তোলে। অন্যান্য সকল বঙ্গালী উপভাষার ন্যায় বরিশালী উপভাষারও ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক এবং বাক্যতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এসকল বৈশিষ্ট্যগুলো হলোঃ

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

  • মহাপ্রাণ ঘােষ ধ্বনি অল্পপ্রাণ ঘােষ ধ্বনিতে পরিণত হয়। যথাঃ মেঘ > মেগ, বাড়ি > বারি, ভাত > বাত ইত্যাদি।
  • শব্দের শেষে ‘ক’ ও ‘খ’ ধ্বনি থাকলে তা ‘হ’ ধ্বনির মতো উচ্চারিত হয়। যেমন: লেখা > লেহা, টাকা > টাহা ইত্যাদি।
  • শব্দে ‘এ’ কারের উচ্চারণের ক্ষেত্রে অনেক সময় ‘এ্যা’ উচ্চারিত হয়। যেমন: তেল > ত্যাল, দিয়ে > দিয়্যা, দেশ > দ্যাশ ইত্যাদি।
  • ই ও উ স্বরধ্বনির ক্ষেত্রে অপিনিহিতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন: মাখিয়া > মাইখ্যা, আজি > আইজ ইত্যাদি।
  • মাঝে মাঝে ‘র’ ধ্বনি ‘ল’ এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন: শরীর > শরীল ইত্যাদি।
  • মাঝে মাঝে অনুনাসিক স্বর ধ্বনিতে অর্ধ-অনুনাসিক ধ্বনির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন: চাঁদা > চান্দা, আঁধার > আন্ধার ইত্যাদি।
  • কখনো কখনো অনুনাসিক স্বরধ্বনির পরবর্তী বর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়। সেই স্থানে অনুনাসিক ধ্বনিটি ‘ন’ বর্ণে পরিবর্তিত হয়ে ব্যবহৃত হয়। যথা: চাঁদ > চান, ফাঁদ > ফান, বাঁধ > বান ইত্যাদি।
  • মাঝে মাঝে ‘ল’ ধ্বনি ‘ন’ এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন: লােনা > নােনা, লাঙ্গল > নাঙ্গল ইত্যাদি।
  • পদের প্রথম অক্ষর ‘শ’, ‘ষ’, ‘স’ ধনী থেকে ‘হ’ ধ্বনি হিসেবে উচ্চারিত হয়। যেমন: শামুক > হামুক, শালিক > হালিক ইত্যাদি।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

  • কর্তৃকারকের এক বচনে ‘এ্যা’ বিভক্তি হয়। যেমন: মরিয়ম স্কুলে গিয়েছে > মরিয়ম্যা স্কুলে গেছে, আমিন বাজারে যাচ্ছে > আমিন্যা বাজারে যাছছে ইত্যাদি।
  • কর্মসম্প্রদানের একবচনে ‘রে’ বিভক্তি হয়। যেমন: তাকে দাও > হ্যারে দেও ইত্যাদি।
  • করণকারকে ‘এ্যা’ বিভক্তি হয়। যেমন: কলম দিয়ে লেখ > কলম দিয়্যা লেহ ইত্যাদি।
  • প্রমিত বাংলায় করণকারকে `দিয়া` বিভক্তি হয়। বরিশালী আঞ্চলিক ভাষায় অপাদান কারকেও `দিয়া` বিভক্তির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন: কলম দিয়া খাতায় লেখমু।
  • ভবিষ্যত কালের উত্তম পুরুষের ক্রিয়াপদে ‘উম’ বা ‘মু’ বিভক্তি হয়। যেমন: করবো > করমু/ করুম, খাবো > খামু/ খাইয়ুম ইত্যাদি।

বাক্য তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

বরিশালের ভাষার বাক্য তাত্ত্বিক কিছু বৈশিষ্ট্য নিচে তুলে ধরা হলোঃ

  • তুমি হেন গেছিলা? > তুমি কি সেখানে গিয়েছিলে।
  • মোর মনে হয় এহন তিনটে বাজে > আমার মনে হয় এখন তিনটা বাজে।
  • আইজ হগলতে একলগে স্কুলে যামু > আজ সবাই একসাথে স্কুলে যাবো।
  • হেরপরে কিয়্যা করমু? > তারপর কি করবো? ইত্যাদি।

এসকল বৈশিষ্ট্য ছাড়াও বরিশাল অঞ্চলে বসবাসকারীদের কথাবার্তায় আন্তঃব্যক্তিক বাচনভঙ্গি ও উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায়।

বরিশালী উপভাষার ইতিহাস

বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল বাংলা ভাষার পথ চলার সাথে সাথেই। মূলত বরিশালী ভাষা হলো বাংলা ভাষার বঙ্গালী উপভাষার একটি বড় অংশ। এই উপভাষার নিজস্ব বৈচিত্র্যময় তেমন ইতিহাস নেই। তবে কালের বিবর্তনে এটি বাংলা ভাষার একটি উপভাষা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এবার বরিশালের ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে নিচে জেনে নেওয়া যাকঃ

বরিশাইল্যা ভাষার উৎপত্তি 

প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে ইন্দো-ইরানীয় > ইন্দো-আর্য > পূর্বাঞ্চলীয় > বাংলা অসমীয়া ও সর্বশেষ বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। ধারণা করা হয়, ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে উপমহাদেশে অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়। তবে তা সর্বত্র ব্যবহৃত হতো না। পরবর্তীতে, ১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে এবং বাংলা ভাষাকে কুন্ঠিগত অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়। ফলে বাংলা ভাষা সমগ্র বাংলার মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে বিস্তার লাভ করে।

বাংলা ভাষার সেই উদ্ভব কালে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বাংলাকে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গিতে প্রকাশ করতো। ফলে অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলা উপভাষার একটি অংশ হিসেবে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষারও উৎপত্তি হয়। 

অতীতে বরিশাল অঞ্চল ‘বাকলা’ নামে পরিচিত ছিল। বাকলা একটি আরবী শব্দ। যার অর্থ শস্য ব্যবসায়ী। ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম এক তীর্থকেন্দ্র ছিল এই বাকলা অঞ্চল। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাণিজ্যিক বিস্তারের জন্য জনৈক ড. কানুনগো নামের এক ব্যক্তি এই অঞ্চলে ‘বাকলা সামুদ্রিক বন্দর’ নির্মাণ করেছিলেন। সেই সামুদ্রিক বন্দরে আরব, পারস্য, ইংরেজ ও পর্তুগীজসহ বিভিন্ন দেশের বণিকরা বাণিজ্য করতে আসতেন। সে সকল বণিকদের সংস্কৃতি, আঞ্চলিকতা ও ভাষা বাংলার ভাষাকে প্রভাবিত করতো। ফলে সেই অঞ্চলের মানুষের কথ্য ভাষায় আঞ্চলিক রূপ সৃষ্টি হয়। 

বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সংমিশ্রণে এসে স্থানীয়দের বাচনভঙ্গি পরিবর্তন, বিদেশি শব্দের ব্যবহার, কথ্য ভাষায় ভিন্ন রকম টান দেখা দেয়। তখনকার মানুষের মুখের ভাষাই মূলত বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা বা বরিশাইল্যা ভাষা ছিল। তবে সেই ভাষার নিজস্ব নাম ছিল না।

বরিশাইল্যা উপভাষার ক্রমবিকাশ

১২০০ শতকের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় মুসলিম শাসন বিস্তার লাভ করে। অন্যদিকে, চন্দ্র রাজবংশের রাজা দনুজ মর্দন ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। অতি প্রাচীন বৈদেশিক মানচিত্রে চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলের অবস্থান স্পষ্ট দেখা যায়। বাকলা অঞ্চলসহ পার্শ্ববর্তী মাদারীপুর ঝালকাঠি, ভোলা, বরগুনা, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ প্রসিদ্ধি লাভ করে। 

সর্বশেষ, ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বরিশালের এই অঞ্চল বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। ১৭৯৭ সালে ঢাকা জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে বাকেরগঞ্জ নামে জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০১ সালে এই জেলার সদর দপ্তরকে বরিশালে (গিরদেবন্দর) স্থানান্তরিত করা হয়। বরিশালের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। তবে এই জেলার নামানুসারেই পরবর্তীতে এই অঞ্চলের ভাষাকে বরিশাইল্যা উপভাষা বলা হয়।

বর্তমানে বরিশালের উপভাষা অনেক বেশি বিস্তৃত। ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রাচীন সেই চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য ও বৃহত্তর বরিশাল জেলা নিয়ে বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে সম্পূর্ণ বিভাগ জুড়ে এবং দেশের অন্যান্য প্রান্তেও বরিশাইল্যা ভাষার ব্যবহার হতে থাকে।

বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার বিস্তার

বরিশালের উপভাষা সাধারণত বরিশাল অঞ্চলের মানুষের বিশেষভাবে ব্যবহৃত কথ্য ভাষা। প্রায় হাজার বছর পূর্বে যখন এই আঞ্চলিক ভাষার উৎপত্তি হয়েছিল তখন থেকেই সমগ্র চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের মানুষের ব্যবহৃত ভাষা ছিল এটি। বর্তমানে বরিশাল বিভাগের বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী, এবং পিরোজপুর জেলার বাঙালিদের প্রধান বাংলা কথ্য ভাষা এটি। 

এছাড়াও বরিশালের পার্শ্ববর্তী লক্ষ্মীপুর জেলা, খুলনা এবং ঢাকা বিভাগের অনেক অঞ্চলের মানুষও এই উপভাষায় কথা বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে প্রায় ৫৫ লক্ষ্য বাঙালী বরিশাইল্যা উপভাষায় কথা বলে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে বরিশাল অঞ্চলের এই বৈচিত্র্যময় বরিশাইল্যা ভাষা সম্পর্কে সমগ্র দেশব্যাপী কৌতূহল রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এই ভাষার প্রয়োগ না থাকলেও বাংলাদেশের ভাষা বৈচিত্রের অন্যতম অংশ বরিশাইল্যা উপভাষা। কৌতুক, বিনোদন, নাট্যাভিনয়ের জন্য এটি অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাষা।

বরিশাইল্যা ভাষার কিছু মজার শব্দ

বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার শব্দগুলো বাংলা শব্দের প্রমিত উচ্চারণ থেকে ভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। তাছাড়া বরিশাল অঞ্চলের মানুষদের নিজস্ব কিছু অর্থবহ শব্দ রয়েছে। নিচে বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ বরিশাইল্যা ভাষার রূপে তুলে ধরা হলোঃ

বরিশাইল্যা ভাষায় প্রাণিবাচক শব্দ 

প্রমিত ভাষাবরিশাইল্যা ভাষা
মোরগরাওয়া
মুরগীমুরহা
বিড়ালবিলোই
কবুতরকইতোর
টাকিটাহি/ চ্যাং
টিকটিকিজেডি
তেলাপোকা তেলাচোরা
খেকশিয়ালপাতিহাল
গাভীগাইওল
সাপহাপ
ছোট মাছপোনা

বরিশালের ভাষায় শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বাচক শব্দ 

প্রমিত ভাষাবরিশাইল্যা ভাষা
হাতআত
হাতের তালুআতের তাউল্যা/ তালকা 
কাঁধ কাঁন্দ
থুতনীহােতমা/ থোতমা/ থোতা
পায়ের গােড়ালীগুরমুইর‍্যা
জিহ্বাজিবরা/ টাগরা
হাঁটুআঁডু
উরুথােরা
ঘাড়ঘেডি
বগলকেতকুলি

বরিশাইল্যা ভাষায় উদ্ভিদবাচক শব্দ

প্রমিত ভাষাবরিশাইল্যা ভাষা
নারিকেলনাহোইল/ নারহৈল
সরিষাহউরা/সইষ্যা 
পেয়ারা হব্রি
জাম্বুরাছোলোম
জামরুললকট
পেঁপেপোম্বা
শিমউশ্যি
শেওলাহিদলা
শটি গাছহডি গাছ
কাকরােলকাহই
তেতুলট্যাংগা
শসাহোয়া
পেঁপেকোম্বা
সরিষার তেলকউররা ত্যাল
রেইন ট্রিশেরেজ গাছ
চম্বল গাছচাম্বল

বরিশাইল্যা ভাষায় বস্তুবাচক শব্দ

প্রমিত ভাষাবরিশাইল্যা ভাষা
রান্নাঘরওশ্যা ঘর
চিরুনীকাহোই
গুরমিডাই
হাস-মুরগীর খাবারআদার
পাতিলপাইলা
ড্রয়িংরুমআইত্না
স্টোররুমউগোইর
বাড়ির পাশের ধান খেতকোলা
মেঝেখাডাল
লাকড়িদাউরা
তরকারীর ঝোলমৌ/ শালুনের হুররা
ঝারুপিছা
চেরাগদানীদেউরহা
কেরোসিনকেরেস্তাল
মাটির পেয়ালাআউত্তা

বরিশালের ভাষার অন্যান্য আকর্ষণীয় শব্দ

প্রমিত ভাষাবরিশাইল্যা ভাষা
বিদ্যুত চমকানােখারাজিল্লি মারা
হান্দানপ্রবেশ করানাে
বামহাতীড্যাবরা
অনর্থক কথাবার্তাপ্যানাপােডা
নিষেধ করামানা হরা
থেমে যাওয়াখ্যামা দেওয়া
শিশুগেদু
বোকাবোগদা
সাঁতারহাতোর
ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে পথছিলা
ঘরের পিছনকাইনাড়ী
সেলাইহিয়ান
উঠানউডান
বজ্রপাতঠাডা
গোছল করানাইতে যাওয়া
টকচুক্কা
গ্যানজামকের্তোন
চাষাবাদআইল্লাডি
মাইরকেনু/ কনি

উপরে উল্লেখিত শব্দগুলো ছাড়াও বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কয়েক সহস্র নিজস্ব শব্দ রয়েছে। 

বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বাক্য

প্রমিত বাংলা ভাষার সাথে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার পার্থক্য বোঝাতে কিছু বাক্য নিচে তুলে ধরা হলোঃ

প্রমিত বাংলা ভাষায় বাক্যবরিশালের ভাষায় বাক্য
তোমার নাম কী?ও মনু, তোর নাম কী?
কোথায় যাও?কোম্মে যাওআয়?
আমি পরে আসব।মুই পরে আমুয়ানে।
তার একটি ছেলে আছে।হের এউক্কা পোলা আছে।
সাজিদ স্কুলে যাচ্ছে।সাজিদ্যা স্কুলে যাছছে।
এই জায়গার নাম কী?মনু, এহানের জাগাডার নাম কী?
এই ছেলে, দুষ্টুমি করো না।এ ছ্যাড়া, বিটলামি হরিস না।
তোমার বাড়ি কোথায়?ও মনু, তোগো বাড়ি কোম্মে?
সকালে কী দিয়ে ভাত খেয়েছো?বেইন্নাহালে কিদ্দা ভাত হাইছো?
সকালে আমাদের বাড়িতে এসো।ও মনু, বেইন্নাহালে মোগো বাড়ি আইয়ো।
দেখ, সেখানে আগুন লেগেছে।দ্যাহো, হেনো আগুন লাগজে।
তাড়াতাড়ি সেখানে যাও।ছ্যাৎ কইররা হেনো যা।
এভাবে হাঁ করে থেকো না, মুখে মশা ঢুকে যাবে।এরহম আক্কইররা থাইকো না, মুহের মধ্যে মশা হান্দাইয়া যাইবে।
আমি সাঁতার কাটতে পারি না।মুই হাতরাইতে পারি না।
শিয়াল আমাদের হাঁসটা খেয়ে ফেলেছে।হিয়ালে মোগো আশটা খাইয়া হালাইছে।
তোমার সাথে একটু পরে কথা বলবো।তোর লগে এট্টু পরে কথা কমুয়ানে

বরিশালের ভাষা শিক্ষা 

বরিশাল অঞ্চলের লোকসংস্কৃতি সেখানের জনজীবনের হৃদয়বৃত্তির অকৃত্রিম ও অবিচ্ছেদ্য অনুভূতি। এই ভাষার অকুণ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে লোকসঙ্গীত, লোকসাহিত্য, লোকশিল্প ও লোকাচারের বিভিন্ন অনুষঙ্গের মাধ্যমে। বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক মর্যাদার এই ভাষার প্রতি সমগ্র দেশের সকল অঞ্চলের মানুষেরই ব্যাপক কৌতূহল রয়েছে। আমাদের মাঝে অনেকেই বরিশালী ভাষায় বিনোদনের ছলে কথা বলে থাকে। তাছাড়া সেই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিকে আপন কথ্য ভাষায় উপস্থাপন করতে বরিশালের উপভাষা শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সমগ্র বরিশাল অঞ্চল সারা বাংলাদেশে তাদের ভাষার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। আপনিও সেই অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির এই ভাষা শিখতে চাইলে, খুব সহজেই বরিশালী ভাষা আয়ত্ত করতে পারবেন। বিভিন্ন উপায়ে বরিশালের উপভাষা শেখা যায়। যথাঃ

(১) বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ শিখে

বরিশালী উপভাষা বাংলা ভাষারই একটা অংশ। তবুও এই ভাষার নিজস্ব শব্দ ভান্ডার অনেক বেশি বিস্তৃত। বাংলা ভাষাকেই বরিশালের মানুষ নিজের আঞ্চলিকতার ছাপে প্রকাশ করতে হাজারো নতুন শব্দের আবিষ্কার করেছে। বরিশালের ভাষা শেখার জন্য সর্বপ্রথম এই সকল শব্দ, শব্দের উচ্চারণ ও প্রমিত বাংলায় সেই শব্দের অর্থ জানতে হবে। এই ভাষার অভিধান শিখতে আপনি বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, বই ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করতে পারেন। 

(২) বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা শিক্ষা অ্যাপ

বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা শেখার জন্য বর্তমানে গুগল প্লে স্টোরে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় একটি অ্যাপ হলো – ‘বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা শিক্ষা‘ অ্যাপ। 

এই অ্যাপসটিতে বরিশালী উপভাষার আকর্ষণীয় শব্দভাণ্ডারের পাশাপাশি বরিশাল অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতি জানতে পারবেন। এছাড়াও ভাষা শেখার উপায়, ইংরেজিতে বরিশালী ভাষা শেখার উপায়, বরিশাইল্যা ভাষায় লিখিত কিছু গদ্য ও কবিতা, এবং স্থানীয়দের কথাবার্তার অংশ উল্লেখিত রয়েছে।

(৩) বরিশালের ভাষা শিক্ষা বই পড়ে

বরিশালের উপভাষা শেখার জন্য বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা শিক্ষা বই পড়তে পারেন। এছাড়াও বরিশালের নিজস্ব উপভাষিক তথ্যবহুল বইও বর্তমানে পাওয়া যায়। বাজার বা অনলাইন থেকে সে সকল বই সংগ্রহ করে শিখতে পারবেন। মিহির সেনগুপ্তের লেখা ‘ভাটিপু্ত্রের বরিশালী গদ্যসংগ্রহ’ বরিশালী উপভাষায় রচিত একটি বই।

(৪) বরিশালের বন্ধুদের সাথে কথা বলে

বর্তমানে খুব সহজেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বরিশালে অবস্থানকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারবেন। তাদের সাথে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বা মতামত জানার মাধ্যমে বরিশাইল্যা ভাষা শিখতে পারবেন। তাছাড়া কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বন্ধু মহলে বরিশাল অঞ্চলের কেউ থাকতে পারে। তাদের সাথে নিয়মিত আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেও বরিশালী ভাষা শেখা যায়।

বরিশালের উপভাষা বাংলা ভাষারই একটি আঞ্চলিক রূপ মাত্র। সেই অঞ্চলের মানুষের বাচন ভঙ্গির কারণে অনেক শব্দ ভিন্ন মনে হলেও, মনোযোগ সহকারে শুনলে আপনিও বরিশালী ভাষা বুঝতে এবং শিখতে পারবেন। 

বরিশাইল্যা উপভাষার অভিধান

বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্যকে ফুটিয়ে তুলতে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান/ বই অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। ২০১৭ সালের একুশে গ্রন্থমেলায় কাগজ প্রকাশন কর্তৃক “বরিশালের ভাষার অভিধান” প্রকাশিত হয়। বইটির রচয়িতা ছিলেন মুহাম্মদ মুহসিন। 

বর্তমান সময়ে আঞ্চলিক ভাষার অভিধান নিয়ে তেমন তথ্যবহুল গ্রন্থ পাওয়া যায় না। তাছাড়া ‘আঞ্চলিক মান’ শব্দগুলো নির্ণয় করাও অত্যন্ত কঠিন। কারণ একই অঞ্চলের ভাষা একাধিক স্থানে ব্যবহৃত হতে পারে। আবার, একই স্থানে একাধিক অঞ্চলের ভাষা ব্যবহৃত হতে পারে। 

বাংলাদেশের এক গ্রাম থেকে পাশের অন্য গ্রামে গেলেই একই শব্দের উচ্চারণে ভিন্নতা দেখা যায়। এসকল বিষয় বিবেচনায় রেখে লেখক ও গবেষক মুহাম্মদ মুহসিন বরিশালের ভাষার অভিধান বইটি রচনা করেছেন। এই বইটিতে বরিশালের একান্ত ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দগুলো অভিধান আকারে তুলে ধরা হয়েছে।

বরিশালী ভাষায় লোকসাহিত্য

আঞ্চলিক লোক সাহিত্যের মধ্যে পুঁথি, সংগীত, প্রবাদ-প্রবচন, শোলক/ ধাঁ-ধা ইত্যাদি অনেক বেশি জনপ্রিয়। বরিশালের উপভাষায় এসকল লোকসাহিত্যের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য জেনে নেওয়া যাকঃ

পুঁথি

এটি বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের অন্যতম শাখা। বাংলার জনজীবনে একে পুঁথি সাহিত্য বলা হয়। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় পুঁথি সাহিত্যের বিখ্যাত নিদর্শন গুলো হলো: ইউসুফ-জুলেখা, গুনাই বিবি, রসুলের মেরাজ গমন ইত্যাদি। এছাড়াও আরো বহু পুঁথি রয়েছে এই ভাষায়।

সংগীত

বরিশালী উপভাষায় যুগে যুগে বহু সংগীত উদ্ভাবিত হয়েছে বিখ্যাত গীতিকারদের দ্বারা। বরিশালের ভাষার এই সংগীতের ধরনগুলো হলো: জারি গান, সারি গান, ভাটিয়ালি গান, যাত্রাপালার গান ইত্যাদি।

প্রবাদ-প্রবচন

পরিহাসপ্রিয়তা হলো বরিশাল অঞ্চলে বসবাসকারীদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সেই অঞ্চলের প্রবীণ নাগরিকরা বিভিন্ন সময় তাদের অভিজ্ঞতাজনিত জ্ঞানকে প্রবাদ-প্রবচনে মাধ্যমে ব্যাঙ্গার্থে প্রকাশ করে। যেমন: 

  • পোলা নষ্ট হাডে, ঝি নষ্ট ঘাডে। 
  • নামের কুডুম যোমে টানে।
  • মাগনা গরু বায়নেও খায়।
  • চেরেরে কয় চুরি হরতে, গিরস্তরে কয় হজাগ থাকতে।

সমগ্র বরিশাল অঞ্চলজুড়ে এরকম প্রায় সহস্রাধিক প্রবাদ-প্রবচন পাওয়া যাবে।

শোলক

গ্রামের লোক সাহিত্যের অন্যতম বিনোদনমূলক ও কৌতূহলের বিষয় শোলক/ ধাঁ-ধা। গ্রামাঞ্চলের শিশুদের দৈনন্দিন বিনোদনের অন্যতম একটি অংশ এই শোলক। বহুকাল পূর্ব থেকেই এটি বুদ্ধির খেলা হিসেবে জনপ্রিয়। বরিশালী উপভাষায় বহু শোলক রয়েছে। কয়েকটি বিখ্যাত শোলক ও তার উত্তর নিচে তুলে ধরা হলোঃ

(১) ভাগের হতিন সখিনা,

রাইত পোহাইলে দেহি না।

উত্তরঃ স্বার্থপর লোক।

(২) এক হাত গাছটা, ফল ধরে পাঁচটা।

উত্তরঃ হাত।

(৩) আল্লাহর কি কুদরত, লাঠির মধ্যে শরবত।

উত্তরঃ আখ।

(৪) জামাই কইন্যার দেহা নাই,

শুক্কুর বার বিয়া ।

উত্তরঃ আগাম চিন্তা ভাবনা।

বরিশাল অঞ্চলের প্রবীণরা এ ধরনের বহু শোলক আত্মস্থ করে রেখেছে। তবে আধুনিক সভ্যতা বিকাশের ফলে দিন দিন সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

বরিশালের ভাষায় লোকসংগীত

লোকসংগীতের বিভিন্ন শাখায় বরিশাল অঞ্চল সমৃদ্ধ। লোকসংগীতের যে সকল শাখায় বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ রয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিচে আলোচনা করা হলোঃ

জারি গান

অতীতকাল থেকে দেশের বিভিন্ন গ্রামীন এলাকায় লোকসংগীতের অন্যতম জনপ্রিয় অংশ হলো জারি গান। বরিশালে জারি গানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। এই সংগীত উপস্থাপনের সময় মূল গায়ক ও তার কয়েকজন সহযোগী একসাথে জারি গান পরিবেশন করেন।

সারি গান

সমবেতভাবে সারিবদ্ধ হয়ে যে গান গাওয়া হয়, তাকে সারি গান বলে। নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার সময়, সরকারি ডিপিএইচই (DPHE) টিউবওয়েল স্থাপনের সময় অংশগ্রহণকারীরা ছন্দময় আওয়াজ এর সাথে তাল মিলিয়ে গান গায়। এটি বরিশাল অঞ্চলে সারি গান নামে অনেক বেশি জনপ্রিয়।

ভাটিয়ালি সংগীত

সাধারণত নদীমাতৃক ভাটি অঞ্চলে ভাটিয়ালি সংগীত জনপ্রিয়। বরিশাল একটি নদীবহুল অঞ্চল। নির্জন নদী-পথে নৌকার মাঝিরা একাকিত্বের অনুভূতি দূর করার জন্য এই গান গায়।

যাত্রাপালা

বাংলার সূচনালগ্ন থেকেই লোকসংগীতের অনেক বড় স্থান দখল করে আছে যাত্রাপালা। বর্তমান সময়েও বরিশাল অঞ্চলের গ্রামগুলোতে যাত্রাপালা আয়োজিত হয়। আঞ্চলিকভাবে ভ্রাম্যমাণ যাত্রাপালার দলগুলো বরিশাল অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে আসছে।

হয়লা বা সয়লা

হয়লা বা সয়লা লোকসংগীত এর অন্যতম ধারা হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। মূলত বিভিন্ন উৎসব কেন্দ্রিক সংগীতকে হয়লা বলা হয়। দেশের বিভিন্ন ধর্মের ও জাতির সম্প্রদায়ের মধ্যে হয়লা সংগীতের প্রচলন রয়েছে। বরিশালী ভাষায় এ ধরনের সংগীতের অনেক নিদর্শন রয়েছে।

এছাড়াও বরিশালের ভাষায় আরো বেশ কয়েক ধরনের লোকসংগীত দেশব্যাপী ছড়িয়ে আছে।

বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বরিশাল

ব্রিটিশ শাসনামলের শেষে ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলায় ভাষা আন্দোলনের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল। তখন থেকে বরিশাল অঞ্চলে সভা-সমাবেশ, মিছিল মিটিংয়ের মাধ্যমে আন্দোলনকে গতিশীল করা হয়েছিল। বরিশালের ছাত্রসমাজ তখন ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে শহর ও গ্রামে জনমত তৈরি করেছিল।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাওয়ার দাবিতে বরিশালে গঠিত হয়েছিল ৮১ সদস্য বিশিষ্ট ‘বরিশাল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ধারাবাহিকভাবে, বারবার বাংলা ভাষার সঠিক মূল্যায়নের জন্য বরিশালের ছাত্রসমাজ অবদান রেখেছিল। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী – খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার এক জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন। তার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ‘রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’। ২৮ সদস্যের এই কর্মপরিষদের ৫ জন সদস্যই ছিল বরিশাল অঞ্চলের। 

সর্বশেষ, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর বরিশালের সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। সেদিন রাত ৯ টায় ঢাকার ছাত্র হত্যার সংবাদ বরিশালে পৌঁছালে বিদ্রোহ মিছিল বের হয়। মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বরিশাল অঞ্চল পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে অবদান রেখেছে। ফলশ্রুতিতে আজও আমরা বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারি।

আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব

আঞ্চলিক ভাষা শুধুমাত্র একজন মানুষের মনের ভাবের আঞ্চলিক রূপকেই প্রকাশ করে না। বরং এটি একটি অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের অন্যতম বাহক। আমরা বাঙালিরা জন্মসূত্রেই বাংলা ভাষায় কথা বলি। তবে বাংলা ভাষার মধ্যে থাকা আঞ্চলিক ভাষাই মূলত আমাদের প্রধান মাতৃভাষা। 

ভাষার আঞ্চলিকতা আমাদের মধ্যে সামাজিকতাকে বিকশিত করে। এটি আমাদের বাংলা শব্দ ভান্ডারকে প্রসারিত করে। আঞ্চলিক ভাষা আমাদের বিনোদনের মাধ্যম, মনের ভাব প্রকাশের সর্বোত্তম উপায় এবং সংস্কৃতিকে ধরে রাখার উপায়। তাই আঞ্চলিক ভাষাকে অবজ্ঞা না করে এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া সকলেরই কর্তব্য।

শেষকথা

উপরোক্ত আলোচনায় থেকে বরিশালের ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। এই ভাষা বাংলার ভাষা বৈচিত্র্যের অন্যতম বড় একটি শাখা। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আঞ্চলিকতার ধারক এটি। তাছাড়া এটি আমাদের লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতি, লোকসংগীত এবং বাংলা ভাষার বিস্তারে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এই ভাষাকে নিয়ে কৌতুক করে। তবে, আঞ্চলিক ভাষাই আমাদের প্রথম ভাষা, আঞ্চলিক ভাষাতেই ফুটে উঠে ভাব প্রকাশের আত্মিক ভালোবাসা।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *